মুজাহিদুল ইসলাম, ঔষধ ও স্বাস্থ্য পরামর্শকঃ
টনসিলাইটিস / টনসিলের প্রদাহ (Tonsilitis):

রোগের বর্ণনা (Disease Description):
জিহবার শেষপ্রান্তে, আলজিহ্বার নীচে বাম ও ডানপাশে বাদামের মত ১.৫ সেন্টিমিটারের মত আকারে লাল বর্ণের মাংসপিন্ডকে টনসিল (Tonsil) বলা হয়।
টনসিল দেখতে মাংসপিন্ডের মতো মনে হলেও এটি লসিকা কলা বা লিস্ফয়েড টিস্যু দিয়ে তৈরি। মুখগহবরের দু’পাশে দুটি টনসিলের অবস্থান। মুখ, গলা, নাক কিংবা সাইনাস হয়ে রোগজীবাণু অন্ত্রের বা পেটে ঢুকতে বাঁধা দেয় এই টনসিল অর্থাৎ টনসিল শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরি করে।

টনসিলাইটিস (Tonsilitis) হচ্ছে টনসিল সমূহ যখন ব্যাকটেরিয়া, ভাইরাস বা ছত্রাকের সংক্রমণ দ্বারা আক্রান্ত হয়ে প্রদাহের বা ইনফেকশনের সৃষ্টি করে ভিন্ন সমস্যা দেখা দেয়। জন্ম থেকেই গলার মধ্যে এই টনসিল থাকে এবং বাচ্চাদের বেলায় টনসিল আকারে বড় দেখা যায় পর্যায়ক্রমে (৫-৬ বছর বয়সের মধ্যে এটি সবচেয়ে বেশি বড় আকৃতিতে পৌঁছায়), বয়স বাড়ার সাথে সাথে টনসিল ক্রমান্বয়ে ছোট হতে থাকে।
কারণ (Causes):

  1. স্ট্রেপটোকক্কাস নামক ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ
  2. ফ্রিজের ঠান্ডা পানি খেলে
  3. আইসক্রিম খেলে
  4. খুব বেশি ঠান্ডা লাগালে

রোগের প্রকারভেদ (Disease Classification):
টনসিলাইটিস সাধারণত দুই ধরনের হয়।
১) একটা হলো তীব্র বা একিউট (Acute)
২) অন্যটি হলো দীর্ঘমেয়াদি বা ক্রনিক (Chronic) টনসিলাইটিস।

রোগের লক্ষণ ও উপসর্গ (Symptol and Sign):

  1. টনসিলের ইনফেকশন হলে মূলত গলা ব্যথা হবে, গিলতে অসুবিধা হবে। শরীরে সামান্য জ্বর থাকবে জ্বরের মাত্রা ৩৯ ডিগ্রী সেলসিয়াস বা ১০৩ ডিগ্রী ফারেনহাইট অথবা এর বেশীও হতে পারে। অনেক সময় গলার স্বর পরিবর্তিত হয়, নিঃশ্বাসে দূর্গন্ধ থাকে। সঙ্গে শিশুর খাবার গ্রহণে অনীহা কিংবা নাক দিয়ে পানি ঝরা ইত্যাদি থাকতে পারে। অনেকের ক্ষেত্রে গলার বাইরে দিকে গ্রন্থি ফুলে যেতেও দেখা যায়।
  2. ভাইরাসজনিত টনসিলাইটিসে টনসিলের প্রদাহ ধীরে ধীরে বাড়ে, ফলে উপসর্গগুলোও ধীরে ধীরে আবির্ভুত হয়। অন্যদিকে ব্যাকটেরিয়াজনিত টনসিলাইটিস হঠাৎ করেই তীব্রভাবে আক্রমণ করে। ফলে উপসর্গ সমূহ এবং গলাব্যথা, জ্বালা পোড়া ইত্যাদি হঠাৎ করেই দেখা দেয়।
  3. শিশুদের বেলায় বমি, পেটে ব্যথা; বড়দের বেলায় মাথাব্যথাও থাকতে পারে। ৫ বছরের কম বয়সীদের বেলায় ডাইরিয়া সহ খাওয়া দাওয়ায় অরুচির লক্ষণ পাওয়া যায় ও সেই সাথে সকলেরই কম বেশি কাশিও হতে পারে।

অ্যাকিউট টনসিলাইটিসের লক্ষণ:

  1. ঠান্ডা-সর্দি
  2. অত্যধিক জ্বর বা জ্বরের সাথে কাঁপুনি
  3. গলাব্যথা
  4. খুসখুসে কাশি
  5. খাবার গিলতে বা পানি পান করতে ব্যথা
  6. নিঃশ্বাস নিতে সমস্যা
  7. মুখের ভেতরে টনসিল বেশ লালচে বর্ণ ধারণ করে
  8. টনসিলের ওপর হলুদ বা সাদা আস্তরণ পড়তে পারে
  9. গলার ভেতর এর আশপাশের অন্যান্য লসিকাগ্রন্থিও ফুলে যাওয়া অথবা গলায় ও মাড়িতে ব্যথা

ক্রনিক টনসিলাইটিসের লক্ষণ:

  1. জিনিসের গন্ধ পাওয়া যায় না
  2. জোর করে ঘ্রাণ নিতে গেলে সবকিছুতেই বাজে গন্ধ পাওয়া যায়
  3. ঘুমাতে খুব অসুবিধা হয়
  4. শিশু ঘুমাতে ভয় পায়
  5. নাক ডাকার সমস্যা হতে পারে
  6. অনেক সময় বাচ্চার ঘুমের ধরণ পাল্টে যায়
  7. মাথাব্যথা
  8. ঘায়ের কারণে গলায় ব্যথা
  9. কানে ব্যথা
  10. ক্লান্তিময়তা

টনসিলের অপারেশন:
ক্রনিক টনসিলাইটিসের কারণ ছাড়াও আরো অনেক কারনে টনসিল অপারেশন করা দরকার। যেমন অনেক ছোট বাচ্চার টনসিলগুলো বড় হয়ে গেছে। টনসিল বড় হয়ে শ্বাসনালী বন্ধ হয়ে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে অসুবিধা হয়। তখন তার ব্রেইনে অক্সিজেন কমে যায়। সে পড়ালেখায় অমনোযোগী হয়ে যায়। সেসব ক্ষেত্রে টনসিল অপারেশন করে ফেলে দেয়া উচিত। টনসিল অপারেশন না করলে রাতে বাচ্চা মুখ হা করে ঘুমায়, নাক ডাকে এবং অনেক অসুবিধা হয়।

কখন অপারেশন করাবেন:

  1. টনসিল বড় হওয়ার জন্য ঘুমের মধ্যে শ্বাসকষ্ট হলে বা নাক ডাকলে।
  2. ঢোক গিলতে বা খেতে বেশি অসুবিধা হলে।
  3. বছরে পাাঁচ-সাতবার রোগের লক্ষণ দেখা দিলে। একাধারে দুই বছর বা প্রতিবছর টনসিলের ইনফেকশন হলে।
  4. টনসিলে একবার ফোঁড়া বা পুঁজ হলে।
  5. ছয় মাস যথাযথ চিকিৎসার পরও না সারলে।

টনসিল অপারেশনের পদ্ধতি:
টনসিল অপারেশনের বিভিন্ন পদ্ধতি আছে। যেমনঃ ডিসেকশন ম্যাথড, ইলেকট্রকটা, লেজার, কোবলেশন আলট্রাসনিক।
ডিসেকশন ম্যাথড বিশ্বব্যাপী জনপ্রিয়। এই উপায়ে অপারেশনের সময় কিছু রক্তপাত হয় এবং রক্তনালিগুলো সেলাই করে দিতে হয়।
লেজার, কোবলেশন এবং আলট্রাসনিক উপায়ে টনসিল অপারেশন অনেক উন্নতমানের কিন্তু ব্যয়বহুল।
ইলেকট্রকটারি, লেজার পদ্ধতিতে টনসিল অপারেশনের সুবিধা হলো এটি রক্তপাতহীন, নিরাপদ, আধুনিক এবং কম সময়ে লাগে। ইলেকট্রকটারি, লেজার পদ্ধতিতে টনসিল অপারেশনে কোনও সেলাই লাগে না। অপারেশনের পরই রোগী মুখে খেতে পারবে। দ্রুত আরোগ্য লাভ এবং দৈনন্দিন স্বাভাবিক কর্মকান্ডে ফিরে যেতে পারে।