মুজাহিদুল ইসলাম, ঔষধ ও স্বাস্থ্য পরামর্শকঃ
শিশুর দাঁত উঠা শুরু হতে থাকলে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব দাঁত মাজতে শিখানো শুরু করে দেয়া উচিত। শিশুদের উপযোগী টুথব্রাশে সামান্য পরিমাণে ফ্লুরাইড যুক্ত টুথপেস্ট ব্যবহার করুন। যে ব্র্যান্ডের টুথপেস্ট ব্যবহার করছেন তাতে শিশুর জন্যে প্রয়োজনীয় ফ্লুরাইড আছে কিনা তা জানার জন্য ডাক্তারের পরামর্শ নিন।

প্রথমদিকে শিশু যদি দাঁত মাজতে তেমন ইচ্ছুক না হয় তবে দুশ্চিন্তা করবেন না। দাঁত ব্রাশ করাকে শিশু যাতে প্রতিদিনের কাজের একটি অংশ হিসেবে ধরে নেয় সেটাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ। শিশুকে দাঁত ব্রাশ করার বিভিন্ন ভালো উদাহরণ দেখাতে পারেন এবং নিজের দাঁত ব্রাশ করে তার সামনে উদাহরণ হিসেবে তুলে ধরতে পারেন।

ফ্লুরাইড

ফ্লুরাইড হল একটি প্রাকৃতিক উপাদান যা আপনার শিশুর দাঁতকে ক্ষয় হওয়া থেকে রক্ষা করে। এই উপাদান সাধারণত বিভিন্ন খাদ্যে থাকে। কোন কোন দেশে বাসায় সরবরাহকৃত কলের পানিতে এটা স্বল্প মাত্রায় মিশিয়ে দেয়া হয়।

দুগ্ধপোষ্য শিশুকে ড্রপের মাধ্যমে এবং শিশুদেরকে ট্যাবলেটের সাহায্যে অতিরিক্ত ফ্লুরাইড প্রদান করা যায়। এসম্পর্কে ডেন্টিস্টের পরামর্শ নিন। টুথপেস্টে যে ফ্লুরাইড দেয়া হয় তা খুবই কার্যকর।

দাঁত ব্রাশ বা মাজার কিছু টিপসঃ

  1. দুগ্ধপোষ্য শিশুকে অতি অল্প পরিমাণে এবং শিশুদেরকে মটরদানা পরিমাণ টুথপেস্ট দিন।
  2. ধীরে ধীরে পুরোপুরিভাবে শিশুর দাঁতের সবদিকে ব্রাশ করা শুরু করে দিন। দিনে দুইবার ব্রাশ করানঃ রাতে ঘুমানোর পূর্বে এবং আপনার প্রাত্যাহিক রুটিন অনুসারে দিনের অন্য যেকোন এক সময়।
  3. সব শিশুই দাঁত ব্রাশ করতে আগ্রহী হবে, এমনটা নাও হতে পারে। সেক্ষেত্রে আপনার উচিত একাগ্রতার সাথে চেষ্টা করে যাওয়া। জোর প্রয়োগ না করে আনন্দের সাথে শিশুকে শিখানোর চেষ্টা করুন। প্রয়োজন হলে শিশুর সাথে সাথে আপনিও নিজের দাঁত ব্রাশ করুন এবং তারপর তাকে তার ব্রাশ করতে সাহায্য করুন।
    শিশুর দাঁত ব্রাশ করার সবচেয়ে সহজ পদ্ধতি হল শিশুকে কোলে বসিয়ে, তার মাথা আপনার বুকের উপরে রেখে দাঁত ব্রাশ করুন। একটু বয়সী শিশুর ক্ষেত্রে তাদের পিছনে দাঁড়ান এবং শিশুর মাথা সামনের দিকে উঁচু করে ব্রাশ করুন।
    ছোট্ট ছোট্ট বৃত্তাকারে ঘুরিয়ে মুখের ভিতরে চারপাশ ব্রাশ করুন এবং এরপর শিশুকে বলুন টুথপেস্ট থুতু করে ফেলে দিতে। গবেষনায় দেখা গেছে , ব্রাশের পর পানি দিয়ে বেশি কুলি করলে ফ্লুরাইডের কার্যকারিতা কমে যায়
    একটি ভিজা কাপড় আঙ্গুলে মুড়িয়ে তাতে সামান্য ফ্লুরাইড টুথপেস্ট নিয়ে তা দিয়ে শিশুর দাঁত ভালোভাবে ঘষে দেবার মাধ্যমেও আপনি আপনার শিশুর দাঁত পরিষ্কার করতে পারেন।
    যতদিন পর্যন্ত শিশু নিজে নিজে ব্রাশ করতে না শিখছে, ততদিন পর্যন্ত তাকে সাহায্য করতে থাকুন। সাধারনত শিশুর বয়স অন্তত সাত বছর না হওয়া পর্যন্ত তাদেরকে ব্রাশ করার ব্যাপারে সাহায্য করতে হয়।

    চিনি বা মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রতি আগ্রহ কমানোঃ

    চিনি আপনার শিশুর দাঁতে ক্ষয়ের সৃষ্টি করে। প্রতিদিন মিষ্টি জাতীয় খাবার খায় এমন শিশুদের দাঁত ক্ষয়ের মাত্রা, তুলনামূলক কম মিষ্টি জাতীয় খাবার খায় এমন শিশুদের দাঁত ক্ষয়ের মাত্রার প্রায় দ্বিগুণ।

    শুধুমাত্র চিনি জাতীয় খাবার বা পানীয় গ্রহণের ফলে ক্ষয়ের সৃষ্টি হয়না। ক্ষয় হওয়া নির্ভর করে চিনি কতক্ষন দাঁতের সংস্পর্শে থাকছে তার উপর। বোতল বা ফিডার কাপে মিষ্টিজাতীয় পানীয় গ্রহণ এবং ললিপপ বা চকলেট খাওয়া দাতের জন্য খুবই ক্ষতিকর, কেননা এগুলো দাঁতে দীর্ঘ সময়ের জন্য চিনির আবরণ তৈরি করে রাখে।

    অ্যাসিডযুক্ত পানীয় যেমন জুস এবং স্কোয়াশও দাঁতের ক্ষতি করে। সেজন্য এসব খাবার প্রধান আহারের মধ্যকালীন সময়ে গ্রহণ না করে প্রধান আহারের সাথে গ্রহণ করা উচিত।

    নিম্নোক্ত পদ্ধতিগুলো আপনার শিশুর খাদ্যে চিনির পরিমাণ কমাতে এবং দাঁত ক্ষয় প্রতিরোধ করতে সাহায্য করবেঃ

    যখন থেকে আপনার শিশু স্তন্য পান ছেড়ে দিবে, তখন থেকে তাকে লবণাক্ত ও মসলাদার খাবার খেতে উৎসাহিত করুন। প্রস্তুতকৃত কেনা শিশু খাদ্য যেমন, রুটি, শিশু পানীয়, স্কোয়াশ এবং সিরাপ ইত্যাদি চিনিযুক্ত কিনা তা যাচাই করে নিন।
    মিষ্টিজাতীয় খাবার ও ফলের জুস শুধুমাত্র আহারের সময় দিন। তাজা ফলের রসে ভিটামিন সি থাকে এবং খাবারের মধ্যে যে আয়রন থাকে ভিটামিন সি তা শোষণে সাহায্য করে। দুই আহারের মধ্যবর্তী সময়ে জুসের বদলে পানি অথবা দুধ দিন।
    উপহার হিসাবে মিষ্টি, চকলেট অথবা বিস্কুট দিবেননা। আত্মীয় কিংবা বন্ধুদেরকেও এটি দিতে মানা করুন। এগুলোর পরিবর্তে স্টিকার, ব্যাজ, রঙ পেন্সিল, গল্পের বই, নোটবুক, রঙ করার বই, সাবান প্রভৃতি উপহার হিসেবে দিতে পারেন। এগুলো মিষ্টিজাতীয় দ্রব্য থেকে অধিক দামী হতে পারে কিন্তু এগুলো দীর্ঘস্থায়ী হয়।
    যদি আপনার শিশু চকলেট বা মিষ্টিজাতীয় খাদ্য বেশি পছন্দ করে, তাহলে তা অল্প অল্প করে বা দুই আহারের মধ্যবর্তী সময়ে না দিয়ে, একবারে অথবা খাবার খাওয়ার পরে খেতে দিন। এ্তে দাঁতের কম ক্ষতি হবে।
    রাতে কিংবা ঘুমানোর সময় শিশুকে জুস ও চিনিযুক্ত পানীয় এর পরিবর্তে দুধ অথবা পানি খাওয়ান।

    শিশুকে ঔষধ দিতে হলে তা যেন চিনিমুক্ত হয় সে ব্যপারে ডাক্তার অথবা ফার্মাসিস্টের সাথে কথা বলুন।

    স্যাকারিন, অ্যাসপারটেম প্রভৃতি কৃত্রিম, চিনির বিকল্প পদার্থযুক্ত পানীয় শিশুদের দিবেননা। একান্তই যদি দিতে হয়, তাহলে দশ ভাগের এক ভাগ এ ধরনের পানীয়ের সাথে নয় ভাগ পানি যুক্ত করে জুস তৈরি করে তারপর দিন।

    তোলা বুকের দুধ, শিশুদের বোতলজাত খাদ্য, ঠান্ডা করা সিদ্ধ পানি বোতল দিয়ে খাওয়ানো যাবে। কিন্তু জুস বা চিনিযুক্ত পানীয় বোতল দিয়ে খাওয়ালে দাঁতের ক্ষয়ের সম্ভাবনা বেড়ে যায়। এসব জুস বা পানীয় কাপে নিয়ে দ্রুত খেয়ে ফেললে দাঁতের ক্ষয়ের সম্ভাবন্লেকমে যায়।

    ৬ মাস থেকে ১ বছর বয়সের মধ্যে সাধারন কাপ দিয়ে শিশুকে জুস বা পানীয় দিতে পারেন।

    আপনার পরিবারের অন্য সদস্যরা কতটা চিনি খায় সেটা যাচাই করুন এবং তা কমানোর পদ্ধতি খুঁজে বের করুন। অন্যদের বেশি মিষ্টি খেতে দেখলে, শিশুও তাই চাইবে।

    সুক্রোজ, গ্লুকোজ, ডেক্সট্রোজ, মল্টোজ, ফ্রুক্টোজ এবং পানি-বিশ্লেষিত শ্বেতসার এসবগুলোই হলো চিনিজাত উপাদান। ইনভার্টেড চিনি বা সিরাপ, মধু, কাঁচা চিনি, বাদামি চিনি, আখের চিনি, মাসকোভাডো (আখের চিনি থেকে তৈরি বিশেষভাবে পরিশোধিত চিনি) এবং ঘনীভূত ফলের রস এসবই হল চিনির প্রতিরূপ।

    মল্টোডেক্সট্রিন চিনিজাত নয়, কিন্তু তারপরও এটি দাঁতে ক্ষয়ের সৃষ্টি করে।